১৩-১৪ বৎসর বয়স আসলেই খুব মজার সময়। বিশেষ করে অজ পাড়াগাঁয়ের হলে বেশ স্বাধীন স্বাধীন একটা বোধ চলে আসে। পাড়াগাঁয়ের স্কুলে পড়ুয়া দুই বন্ধু পলাশ আর শিমুল। শিমুল কিছুটা অবস্থা সম্পন্ন ঘরের কিন্তু পলাশ নিতান্তই গরীব পরিবারের সন্তান। কিন্তু দুইজনের বন্ধুত্বে এই সম্পদের বৈপরিত্য কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। দুই বন্ধুর একসাথে স্কুলে যাওয়া ছাড়াও একসাথে হাটে যাওয়া, একসাথে মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে কড়া রোদে জাম গাছে বা আম গাছে উঠে ফল খাওয়া নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। যেহেতু অনেক কাজেই পরিবারকে সাহায্য করে তাই পরিবারের কিছু শাসনের ব্যতিক্রম তারা ভোগ করে। ক্লাসে খুব খারাপ ছাত্র নয়। শিমুল ১ম পলাশ ৫ম। এই নিয়ে পলাশের মনে কোন ক্ষোভ যে নাই, তা বলা যাবে না। এক্কেবারে হুবুহু লেখার পরেও শিক্ষক ওকে সমাজে এক প্রশ্নের উত্তরে দিয়েছেন ১০ এ ৪ , শিমুল কে দিয়েছেন ১০ এ ৭। শুধু সমাজে নয় ধর্ম, ভূগোল, বাংলায় একই অবস্থা। তাই বৎসর শেষে ফল প্রকাশে পলাশ হয় ৫ম, শিমুল হয় ১ম।
প্রতি বৎসর ফেব্রুয়ারী মাসে ওদের স্কুলের জীবিত উদ্যোক্তাকে খুব আন্তরিক দেখা যায়। উনি একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন । ১৯৫৩ সালে উনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এক বন্ধুর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে থাকতেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে এই স্কুল দিয়েছেন। স্কুলের অনেক কিছুর মত এখানে সকালে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, শপথ নেয়া বাধ্যতামূলক। সেই স্কুলের মাঠে খুব চিকন করে ৩ টি স্তম্ভ দাঁড় করিয়ে একটি শহীদ মিনারও বানানো হয়েছে। সেখানে ২১ ফেব্রুয়ারীর সকাল ৭ টায় স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী সহ ৭ম-১০ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ফুল দিতে যেতে হয়। গ্রামের স্কুল হলেও ছেলেমেয়ে একসাথে এখানে লেখাপড়া করানো হয়। সমস্যা শুধু ৭ম শ্রেণী থেকে উপরের ক্লাসে মেয়ারা ক্লাসে যায় শিক্ষকের পিছে পিছে, আসেও ক্লাস শেষে একইভাবে। সেই স্কুলে শীতের ভোরে শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং গন্যমান্য ব্যক্তিদের আগমনে দিনটি খুব আনন্দেই কাটে। ৮ -১১ টা পর্যন্ত চলে গান, নাচ, কবিতা আবৃতি ও উপস্থিত বক্তৃতা। মজার বিষয় হল সকল বিষয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতি। সকলেই একসাথে প্রতিযোগিতা করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে ছোট ক্লাসের একটু মনোকষ্ট থাকলেও ভাষা সৈনিক প্রতিষ্ঠাতার এক কথা, আমরা যখন প্রতিবাদ করেছি সেখানে ছোট বড় একসাথেই করেছি। এখানে সমস্যা কেন হবে ! এরপর কেউ এর প্রতিবাদ করেনা। কিন্তু মূল কথা স্কুলের ফাণ্ড কম বলে বেশী পুরস্কার কেনা যায় না।সেজন্য কম পুরস্কার দেয়ার উদ্দেশ্যেই সকলকে একসাথে প্রতিযোগিতায় আনা।
পলাশ শিমুল ২০ তারিখ বিকেলে বের হয়েছে ফুল যোগাড় করতে। কিন্তু একমাত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে ৩ টি টবে সর্বমোট ৫ টি গোলাপ ধরে আছে। আর কোথাও কোন ফুল দেখতে পায়নি। এমন কি থানা রেভিনিও অফিসের বাগানেও কোন ফুল নাই। শিমুল একবার প্রস্তাব দিল প্রধান শিক্ষকের বাসার ফুল গুলো চুরি করে নেয়া যেত পারে। কারণ ২১শে ফেব্রুয়ারি ফুল চুরি করে দিলে কোন পাপ হয়না। পলাশের খুব আপত্তি। চুরি দিয়ে কাউকে সম্মানিত করা ঠিক হবে না। ওরা খুঁজতে খুঁজতে গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে প্রায় ১ মাইল দূরে গোরস্তানের পুকুর পাড়ে ফুল খুঁজতে গেল। পুকুর খুব ঘন অন্ধকার। ওরা যেতেও দেরী করেছে। এরপরেও একটি বাঁকানো পলাশ গাছ , শৈশবের ৪ টি শক্তিশালী চোখ ফাঁকি দিতে পারল না । যে গাছটির বেশীরভাগ হেলে পড়েছে পুকুরের মাঝে। ওরা আস্তে আস্তে গাছের মাথায় গেলো। কাপড়ের ব্যাগ ভরে ঈষৎ হলুদ রঙের পলাশ ফুল নিয়ে নেমে এলো। কিন্তু পলাশের মন ভরল না এই ফুলের রঙে। ওরা গাছ থেকে নামার সময় দেখল বেশ বড় এক শিমুল গাছে লাল আগুন জ্বলছে। সন্ধ্যার লালচে আভায় এই রং আরও রক্তের মত লাল হয়েছে। দুজনের ভিতর তখন জীবনের প্রথম ভাষা শহিদদের সম্মান জানানোর উন্মাদনা। দুজনে একে অপরকে সাহায্য করে শিমুল গাছে উঠল। দুইজনেই কোছা ভরে ফুল নিয়ে ন্যাংটো হয়ে গাছ থেকে নামল। উত্তেজনায় কেউ বুঝল না শরীরের কত জায়গায় ছিলে তখন রক্ত ঝরছে ! নীচে নেমে এত্ত গুলো ফুল নেওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায় ভাবতে লাগল। শিমুল পলাশকে একটি কলা গাছ দেখিয়ে কয়েকটি পাতা আনার জন্য বলল। পলাশ কলার পাতা ছিঁড়তে একটু দূরে পুকুরের পাড়ে গেলো। ওর শরীর খুব চুলকাচ্ছিল। কিন্তু আনন্দে সেই চুলকানিকে পাত্তা দিল না। পাতা ছিঁড়তে গিয়ে মনে হল এই চুলকানির হার আরও বেড়ে গেলো। কলাপাতায় করে শিমুল ফুল আর ব্যাগে করে পলাশ ফুল নিয়ে ওরা যখন ফিরল, তখন গ্রামে অনেক রাত। প্রায় প্রতি বাড়িতে খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করে ঘুমাতে যাচ্ছে। ওরা ফুল গুলো লুকিয়ে রেখে মসজিদের পুকুরে গা হাতপা ধুয়ে বাড়ি গেলো। কেউ ওদের দিকে তেমন করে খেয়াল করল না। ফজরের নামাজের পর শিমুল এসে পলাশকে ডাকল। পলাশের শরীর ভীষণ ফোলা এবং গাঁয়ে ভীষণ জ্বর। শিমুলের শরীরেও জ্বর জ্বর ও ব্যাথা। দুইবন্ধু উত্তেজনায় সকল বাঁধা উপেক্ষা করে স্কুলে গেলো। অনেকেই এসেছেন কিন্তু শুন্যহাতে। ওদের নেয়া ফুল পেয়ে সকলে খুব খুশী হল। বিশেষ করে ভাষা সৈনিক তার মূল বক্তব্যে ওদেরকে খুব ধন্যবাদ দিলেন। ওদের এই প্রচেষ্টার জন্য সকলে শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারলেন। অন্যরা কেন ওদের মত করে ফুল সংগ্রহ করেনি, সেজন্য অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করলেন। প্রধান শিক্ষকের টবের ফুল রাতে কে বা কারা চুরি করেছে বলে তিনি তার বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। এতে চুরি করা গোলাপ ফুল গুলো বেদিতে কেউ দিতে এলো না। পলাশ শিমুল এর সমস্ত ফুল কাজে লাগায় ওরা খুব গর্বিতবোধ করছিল।
বেলা ১০ টার দিকে উপস্থিত বক্তব্য হচ্ছিল। পলাশ কি মনে করে বক্তব্য দিতে গেল। ওর বক্তব্যের বিষয় ৫২ এর আন্দোলন ৭১ এর স্বাধীনতার আন্দোলনে কোন প্রভাব ফেলেছিল কিনা? পলাশ জোরালো চোখ ছল ছল করে যুক্তি দিয়ে প্রমান করল যে, অবশ্যই প্রভাব রেখেছে এবং তা ধনাত্মক। তার ভেজা স্বর বিচারকদের আবেগী করে দিল। পলাশ কলেজের ছাত্রদের হারিয়ে ১ম হল। যদিও এই ভরাট চোখের ছল ছল ক্রন্দের ভাষা কি বক্তব্যের বিশেষ গুরুত্বের জন্য, না তার শরীরের জ্বর ও এলারজির জন্য শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় হয়েছে, তা কেউ বুঝতে পারল না। পুরুস্কার নিয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। বাড়ির পাশে এসে তার দুই পা আর চলছিল না। শিমুল তাকে প্রায় কাঁধে করে বাসায় নিয়ে এলো। ওর মা গায়ের জ্বর দেখে মাথায় জল পট্টি দিতে শুরু করল।
রাতে শিমুল খবর পেলো পলাশের অবস্থা নাকি ভালো না। ও দৌড়ে পলাশের বাড়ি গেলো। পলাশের বুক তখন কামারের হাঁপরের মত উঠা নামা করছে। একটু পর মুখ দিয়ে সাদা ফেনা পড়তে দেখল। পলাশ ওকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘শিমুল খুব কষ্ট বন্ধু। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ! আমি আর বাচবনারে !’ শিমুল কি করবে বুঝতে পারল না। দৌড়ে গ্রামের কবিরাজ হাসান চাচাকে ডেকে আনল। উনি এসে অনেক্ষন ডান হাতের কবজি ধরে বসে থাকলেন। প্রায় আধাঘণ্টা এরূপ থেকে বললেন দাই লাল পিপড়ার কামড়ের বিষক্রিয়া হয়েছে। এখন খুব খারাপাবস্থা । একমাত্র আল্লাহ্ পাক ইচ্ছে করলেই শুভ কিছু হতে পারে। কেউ একজন এশার নামাজ পড়াতে আসা হুজুরের পানি পড়া নিয়ে এলো। শিমুল ঐ পড়া পানি চামুচে করে পলাশের মুখে দিল। কিন্তু সেই পানির সবটুকু গালের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পরে গেল। শিমুল খেয়াল করে দেখে পলাশের বুক থেমে গেছে । প্রানের বন্ধু পলাশ নিশ্চল নিস্তব্ধ হয়ে গেছে! শিমুলের আর্তচিৎকারে গোটা গ্রামের মানুষ এসে হাজির হল। রাতেই দ্রুত পলাশকে দাফন করা হল। কারণ হুজুরের ধারণা শিমুল গাছের ভুতের আছরে ওর মৃত্যু হয়েছে। পলাশের কবরে আর মাটি দেয়া হলো না শিমুলের। বাসায় এসে সে অচেতন হয়ে ভুল বকতে শুরু করল। ওর বাবামা ওকে নিয়ে রাতেই শহরের হাসপাতালে রওয়ানা দিয়েছিল। তাই আজও শিমুল এই পৃথিবীর রূপ রস অক্সিজেন প্রান ভরে গ্রহণ করতে পারছে।
ওইবারই জীবনের প্রথম এবং শেষবার শিমুলের শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছিল । আর কোনদিন সে শহীদ মিনারের দিকে তাকাতে পারে নাই । পরিনত বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদয়ালয়ে লেখাপড়া করে এবং ঢাকার সচিবালয়ে চাকুরি করেও আর কোনদিন কেউ তাকে শহীদ মিনারে যেতে দেখেনি। কলিগদের কেউ এই জন্য তাকে রাজাকার বলেও গালমন্দ করেছে । প্রতি বৎসর ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে পত্রিকায় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের দেয় ফুলের সাজানো ফুলের ছবি ছাপা হয়...শিমুল শুধু স্তরে স্তরে সাজানো পলাশ আর শিমুল ফুলকেই দেখে। যদিও ঢাকা শহরে জনগণ অনেক পদের ফুল শহীদ মিনারে দেয় ! হরেক রঙের গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, রজনীগন্ধা, জবা... শিমুলের চোখে শুধু ধরা পরে পলাশ আর শিমুল ফুলের স্তুপ !
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
২৯ জুন - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।